সোমবার, ৭ মার্চ, ২০১৬

বরিশাল ভ্রমণ

হক সাহেবের দেশে :

(একটি জায়গায় যাবার আগে যদি তার ইতিহাস জেনে যান তবে ভ্রমণের আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুন। আর সেজন্যই শহর বরিশাল নিয়ে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস)

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এর নাম শোনেননি এমন মানুষের দেখা পাওয়া ভার। একাধারে শিক্ষিবিদ, আইনজীবি, দানবীর, সুবক্তা হিসেবে তিনি পাক ভারত উপমহাদেশে সুপরিচিত ছিলেন। বাংলার বাঘ হিসেবে খ্যাত অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ,কে ফজলুল হক এর দেশ, ধান নদী খাল এর দেশ বরিশাল ঘুরে আসতে পারেন ২-১ টা দিন সময় পেলে।

বরিশাল- এখানকার অধিবাসীরা আদর করে ডাকে বইরশাল। বরিশালের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। এর প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ। প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ইন্দোচীন থেকে 'বাঙ' নামের এক জাতি এ চন্দ্রদ্বীপ এ বসতি স্থাপন করে। বাঙ শব্দের অর্থ জলাভুমি। 'বাঙ' নামের এ জাতিটি তাদের ক্ষেতে আল দিয়ে চাষ করত বলে এ এলাকাকে বাঙালাবাদ বলা হত।

এই বাঙ্গালাবাদ থেকেই বাঙালী শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। পাল এবং সেন আমলেও বঙ্গ বলতে এই দক্ষিন বঙ্গকেই বোঝাত। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন- দক্ষিনবঙ্গের বাঙালা থেকেই আজকের বাংলার নামকরন হয়েছে। আর বরিশাল নামটি এসেছে ব্যারিসল্ট থেকে। সপ্তদশ শতকে এখানকার বন্দরে ইউরোপীয় বণিকেরা লবন বাণিজ্য করতে আসতো। নদীতে ব্যারিকেড দিয়ে সল্ট এর শুল্ক আদায় করা হত বলে নামকরন করা হয়ে ব্যারিসল্ট কালক্রমে যা হয় বরিশাল।

কি দেখবেন : শহর বরিশালে রয়েছে অনেক কিছু দেখার। নীচে কিছু দেয়া হল।
স্টিমার ঘাট :

কীর্তনখোলা নদীর তীরেই স্টিমার ঘাট এর অবস্থান। বেশ বড় একটি জেটি প্রায় সময় খালি থাকে। তবে খুব সকাল আর সন্ধ্যায় স্টিমার ঘাটে ভিড়লে এর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভেবে রোমাঞ্চিত হবেন যে প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে ইল্যাংন্ড এর রিভার এন্ড স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) কোম্পানীর বিশাল বিশাল সব স্টিমার চলাচল করতো এ ঘাট দিয়ে। বাহারী নাম ছিলো সে সবের- ফ্লেমিংগো, ফ্লোরিকান, বেলুচি ইত্যাদি। বরিশাল থেকে ঢাকা, খুলনা, কোলকাতা যেতে স্টিমারই ছিলো ভরসা।

বলা হয়ে থাকে বৃটিশ সরকার নাকি বরিশালে রেলপথ সম্প্রসারনের উদ্যোগ নিয়েছিলো কিন্তু স্টিমার কোম্পানীর মালিকেরা ব্যবসা হারানোর ভয়ে লন্ডনে বসে সে উদ্যোগের দফারফা করে দেয়। বর্তমানে নুতন পুরোনো মিলিয়ে সপ্তাহে ৬ দিন স্টিমার চলাচল করে।

অশ্বিনী কুমার টাউন হল :

শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে অশ্বিনী কুমার টাউন হল। একদা দক্ষিনাঞ্চলের সাংষ্কৃতির সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত এ টাউন হলটিরও রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ১৯০৬ সালে রাজা সাহেবেের মহলে বৃটিশবিরোধী মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। সে সময় এ ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য বরিশালবাসি একটি স্থানের প্রয়োজনীয় অনুভব করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে মহাত্বা অশ্বিনী কুমার দত্তের সভাপতিত্বে বরিশালে একটি টাউন হল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯২১ সালে এর কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৩০ সালে। মাঝে ১৯২৩ সালে অশ্বিনী কুমার এর মৃত্যু হলে এর নামকরন করা হয় অশ্বিনী কুমার টাউন হল। এটি নির্মানে খরচ হয় ৪০ হাজার রুপি। আর এ অর্থ সংগ্রহ হয় খেলাফত আন্তোলন, অসহযোগ আন্দোলন এর সময় গৃহীত ফান্ড থেকে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই টাউন হলটিতে বরিশালের নানা সাংষ্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। বরিশাল এর আরেক সুসন্তান বিপ্লবী সতীন্দ্রনাথ সেন এই হলের একটি রুমে থাকতেন।

বি এম কলেজ : প্রায় ১২৬ বিঘা জমির ওপর দাড়িয়ে থাকা বি এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ একটি দর্শনীয় স্থান। কলেজটির রয়েছে এক দীর্ঘ ইতাহাস। বরিশালের ম্যাজিষ্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুপ্রেরনায় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৪ সালে তর বাবার নামে ব্রজমোহন ইন্সটিটিউট স্কুল (বিএম ইন্সটিটিউট) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৯৮ সালে এটি কলেজে উন্নীত হয়। তখন থেকেই এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সুনামের সাথে দক্ষিনাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার করে আসছে। সে সময় প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা ভারতে শতকরা ২২ ভাগের বেমি পাস করেনি কিন্তু বিএম ইন্সটিটিউট থেকে শতকরা ৮২ ভাগ ছাত্র পাস করলে সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে সময় প্রফেসর ক্যানিংহাম বি এম কলেজ পরিদর্শন করে রিপোর্ট দ্যান : "বি এম কলেজের মতো উতকৃষ্ট কলজে থাকিতে বাঙালী ছেলেরা বিদ্যা শিক্ষার জন্য কেন অক্সফোর্ড যায়, আমি বুঝিতে পারিনা।"

তবে এর কিছুদিন পরেই কলেজটি বৃঠিশ সরকারের রোষানলে পড়ে অশ্বীনি কুমারের স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পরার কারনে। এ আন্দোলনে কলেজের বহু শিক্ষক এবয়ং ছাত্ররা অংশগ্রহন করে। তারা গান বেধেছেন, মিছিল করেছেন, জেল খেটেছেন এবং বিদেশী দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। বরিশালের সাধারন মানুষও এ আন্দোলন এ যোগ দেয়। বরিশালে সব বিদেশী পণ্য আমদানী বন্ধ হয়ে যায়। জনতা লাট সাহেবের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করে। এর ফলে বৃটিশ সরকার ক্ষেপে গিয়ে কলেজের সব সরকারি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। বৃত্তি প্রদান বন্ধ করে দেয়,ছাত্ররা পাস করে যাতে সরকারি চাকরি না পায় তার ব্যবস্থা করে। সে সময় দেবপ্রসাদ ঘোষ এন্ট্রাস পরীক্ষায় সারা ভারতে প্রথম হন। প্রথা অনুযায়ী তাকে সোনার মেডেল এবং বৃত্তি দেবার কথা, কিন্তু তাও দেয়া হয়নি।

২ য় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলেজটি আবার বির্যয়ের মুখে পরে। ১৯৪৭ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কারনে কলেজের দুই তৃতিয়াংশ ছাত্র দেশ ত্যাগ করে ফলে কলেজটি অনার্স কোর্স বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় এবং কোন মতে পাস কোর্স নিয়ে চলতে থাকে। ১৯৬৪-৬৫ সালে আবার অনার্স কোর্স চালু হয়। বহু গণি লৌকের পদভারে মুখরিত ছিলো এ কলেজ। কবি জীবনানন্দ দাশ এ কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে আইএ পাস করেন।

বিবির পুকুর : বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে দারুন সুন্তর একটি পুকুর যা বিবির পুকার নামে পরিচিত। এটিও দেখতে ভুলবেন না। সন্ধ্যার দিকে আলো ঝলমলে পুকুরটির পাড়ে বসে আড্ডা আর খাবারের নানান সমারোহ। আসুন দেখি এ পুকুরটি কি করে হলো।

বাংলা মুদ্রন সাহিত্যের জনক বলে পরিচিত উইলিয়াম কেরি ১৮০০ শতকে কিছু দিন বরিশাল ছিলেন। সে সময় তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের কাছ থেকে জিন্নাত বিবি নামে এক মহিলাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু সে সময় সেখানকার সমাজ মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে না চাইলে কেরি নিজেই তাকে আশ্রয় দেন এবং জিন্নাত বিবির নামে একটি তালুক কেনেন। জিন্নাত বিবি সে তালুক নিজে ভোগ না করে জনসাধারনের জন্য একটি পুকুর খনন করান যা ওই এলাকার জলকষ্ট দুর করতো। এটিই পরে বিবির পুকুর নামে পরিচিতি পায়। পুকুর পাড় এ কেরি সাহেব একটি গির্জাও তৈরী করেন য বরিশাল এলাকার প্রথম গির্জা। এটি তৈরিল কারনে এলাকাটির নামই হয়ে যায় গির্জা মহল্লা।

বেলস পার্ক : নির্মল বাতাস খেতে যেতে পারেন বেলস পার্ক। গত শতকের গোড়ার দিকে বরিশারের ডিস্টিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন নিকোলাস বিটসন বেলস। তিনি ছিলেন ভারত দরদী ইংরেজ। বরিমালের জন্য তার ভালোবাসার অন্ত ছিলোনা। বহু জনকল্যানমুখি কাজ করে গেছেন তিনি। এই নিকোলাস বেলস ১৯০৯ সালে বরিশালে তরুনদের খেলাধুলার জন্য একটি পার্ক তৈরী করেন পরবর্তীতে যার নামকরন করা হয় বেলস পার্ক।

চারন কবি মুকুন্দ দাসের বাড়ি : বৃটিশ সরকার এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালনকারি চারন কবি মুকুন্দ দাসের শৈশসব, কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে বরিশালে। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে তিনি একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেনঅ নাম দেন ্বান্দময়ী মন্দির। নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ড এর পাশেই এ মন্দিরে নেতাজি সুভাব বসু, দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক বিখ্যাত মাুনষজন গিয়েছেন। আপনিও ঘুরে আসুন।

ওপরের এগুলো ছাড়াও দেখতে পারেন :

মাধবপাশা দুর্গাসাগর দীঘি : শহর থেকে প্রায় ১২ কি:মি দুরে এ ২৫০০ হেক্টর আয়তন এর এ দিঘীটি ১৭৮০ সালে খনন করান মাধবপাশা রাজ্যর রাজা জয়নারায়ন। দিঘীটির চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং মাঝে রয়েছে একটি দ্বীপ। একটি বিকেল কাটাবার জন্য দারুন সুন্দর একটি স্থান এটি।

গুঠিয়া বায়তুল আমান মসজিদ : বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর মসজিটি অবস্থিত বরিশাল থৈকে ২৫ কি:মি: দুরের গুঠিয়ায়। দুর্গাসাগর থেকে ১০ মিনিট লাগবে যেতে।

চাখার শের এ বংলার বাড়ি : বরিশাল শহর থেকে প্রায় ৩২ কি: মি: যদিও বাড়িঘর নেই তবে তার স্মৃতির একটি যাদুঘর আছে এবং তার প্রতিষ্টিত কলেজ ও স্কুল রয়েছে বেশ কটি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় : আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত। শহর থেকে ৪-৫ কি:মি: দুরে।

source: বেড়াই বাংলাদেশ

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=549508918552007&id=223755871127315

কোন মন্তব্য নেই: